সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো বাংলাদেশ ও ভারতে ২০১৪ সালের জাতীয়
নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব,
ব্লগগুলো নির্বাচনী প্রচারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ প্রকাশের ক্ষেত্রে
শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
জনে জনে গিয়ে ভোট চাওয়ার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে
অনেক মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেওয়া সহজতর। ইন্ডিয়া টুডের
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে এর মধ্যেই
ভারতের রাজনৈতিক দল বিজেপি ও কংগ্রেস সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটিকে বেছে
নিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছে।
শাহবাগে শুরু হওয়া ‘গণজাগরণ’-এর সূত্রপাত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার
করেই শুরু হয়েছিল। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার জন্য এ প্লাটফর্মটির প্রতি
মানুষের আগ্রহ বাড়ছেই।
ভারতে সামাজিক যোগাযোগে নির্বাচনী প্রচারণা
নির্বাচন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো কতটা
গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, সে তথ্য ‘ইন্ডিয়া টুড’-এর সাম্প্রতিক একটি
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের রাজনৈতিক দল বিজেপির
নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে কাজ করছে একদল তরুণ। বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি
বিশেষজ্ঞদের তরুণ একটি দল ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে দলটির নানা কর্মকাণ্ডের
ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে কাজ করছে। নতুন ভোটার আর তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা
বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটি কাজে লাগাচ্ছে দলটি। সামাজিক যোগাযোগে
দক্ষ এসব কর্মীর বেশির ভাগই দলটির কর্মী-সমর্থক, যাঁরা বিনা বেতনে দলের
জন্য কাজ করছেন।
ভারতের আরেকটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেসও পিছিয়ে নেই। এ দলটির ১০ জন সদস্যকে
নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘যোগাযোগ ও প্রচারণা কমিটি’। এ কমিটির সদস্য দিগবিজয়া
সিংহাল বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর গুরুত্ব হেলাফেলা করার মতো
নয়।’ ভারতের রাজনীতি ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করছে কংগ্রেস। তাই দলটির
বিভিন্ন সংগঠনের কাছে বিভিন্ন বার্তা পৌঁছাতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম
ব্যবহার করছে দলটি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপ্যাধায়ও তিন
স্তরবিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দল তৈরি করেছেন। এর মধ্যে একটি দল সামাজিক
যোগাযোগের ওয়েবসাইটে তাঁর হয়ে কাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে ভারতের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারতে সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যমগুলোর শক্তিশালী ভূমিকা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্না
হাজারের প্রতিবাদের বিষয়টি টুইটারে সাড়া ফেলেছে। দিল্লিতে গণধর্ষণের ঘটনায়
সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রটিতে মানুষের প্রতিবাদ সবার মনোযোগ কেড়েছে।
সর্বস্তরের মানুষকে এক করতে পেরেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।
নতুন বাংলাদেশ
সামাজিক যোগাযোগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাহবাগের আন্দোলন ঘিরে তৈরি হয়েছে
নানা জল্পনা-কল্পনা। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে মানুষ ভাবছেন বিকল্পের কথা।
হাসিনা-খালেদা-এরশাদ-সামরিক শাসন—সব অভিজ্ঞতা এখন মানুষের হয়েছে।
স্বাধীনতার চার দশক পরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনী
বিপ্লবের সম্ভাবনার বিষয়টি ভাবছেন এখনকার তরুণেরা। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই
বন্ধ রয়েছে ইউটিউব। তবে ফেসবুক, ব্লগ আর টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের
ক্ষেত্রগুলোতে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই শক্তিশালী মাধ্যমটিই
বাংলাদেশে গণজাগরণ তৈরি করতে পেরেছে। সামাজিক যোগাযোগের প্লাটফর্ম ব্যবহার
করে মানুষ জড়ো হয়েছে শাহবাগে। তৈরি হয়েছে ‘প্রজন্ম চত্বর’। কোনো ঘটনা ঘটার
সঙ্গে সঙ্গে তা সবার আগে চলে আসছে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে।
সবখানে তা ছড়িয়ে পড়ছে মুহূর্তেই। আগামী নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগের
ক্ষেত্রটি ভারতের মতো বাংলাদেশেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তরুণদের ভাবনা,
আলোচনা-সমালোচনা থেকেই ভোটাররা জানতে পারবেন প্রার্থী, ভোটকেন্দ্র,
ভোটারদের তথ্য। এ ক্ষেত্রটির মাধ্যমেই নির্বাচনী কারচুপি হলেও তা মুহূর্তেই
সবার কাছে পৌঁছে যাবে।
আরব বসন্ত
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের প্রভাবের কারণেই মিসরে ‘আরব বসন্ত’ বা
সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব দানা বেঁধে উঠেছিল। আরব বসন্তের পেছনে গুগল,
ফেসবুক ও টুইটারকে কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকেই। কারণ, আরব বসন্তের শুরুতে
মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুকের সাহায্য নিয়ে
তরুণেরা যোগাযোগ করেছেন, একত্র হয়েছেন এবং ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন
হোসনি মোবারককে। এই বিপ্লবের সফলতার জন্য সামাজিক যোগাযোগ ‘অস্ত্র’ হিসেবে
ব্যবহূত হয়েছে। মিসরের জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের দাবিতে
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বিপ্লবীরা।
ফেসবুক কেন হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের মাধ্যম? শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অনলাইনে
তথ্য বা মত প্রকাশের জন্য নির্যাতনের শিকার হন পোস্টকারী। এরপর নির্যাতনের
খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে। টুইট, ইউটিউব
ভিডিও, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় প্রতিবাদ ঝরে পড়তে শুরু করে। এ
থেকেই সচেতনতা ও প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। তিউনিসিয়া, মিসরসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর
মর্মস্পর্শী ছবি যখন অনলাইনে পোস্ট করা শুরু হয়েছিল, সেগুলো দ্রুত সারা
বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং আরব বসন্তের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ সুযোগটাকে
পশ্চিমা বিশ্ব দ্রুত লুফে নিয়েছিল এবং তাঁদের সাফল্য হিসেবে উদযাপন করতে
শুরু করেছিল। এদিকে, আরব বসন্ত বা ফেসবুক বিপ্লবের এই ধারণা দ্রুত সারা
বিশ্বের মানুষের মনে গেথে যায়।
সামাজিক যোগাযোগের এই সাইটগুলো কি এ ধরনের বিপ্লবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
অস্ত্র বা মোক্ষম হাতিয়ার বা বিপ্লবের রসদ জোগাতে সক্ষম? আরব বসন্তের এক
বছর পরও প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত গবেষকেরা। সামাজিক যোগাযোগের
সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে।
নির্বাচন ২০১৪
লন্ডনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট বিশ্লেষক সোসালব্রেকার্সের তথ্য
অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ আর ভারতে ১৪ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী
রয়েছেন। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে কোনো তথ্য পৌঁছালে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে
এবং মূল মিডিয়ার চেয়েও শক্তিশালী হিসেবে কাজ করে। আর এ ক্ষমতা সামাজিক
পরিবর্তন আনতে পারে। ভারতের রাজনৈতিক নেতা মিরা সান্যালের মতে, সামাজিক
যোগাযোগের ওয়েবসাইটকে দুভাবে রাজনৈতিক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এক
হচ্ছে, এ অঞ্চলের মধ্যবিত্তদের একত্র করার কাজ। মধ্যবিত্তদের ধারণা, তাদের
ভোট রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলে না। তাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য
সামাজিক যোগাযোগ যথেষ্ট। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর কলাম লেখক টমাস ফ্রায়েডম্যান
লিখেছেন, ভারতের রাজনীতিতে ভারচুয়াল মধ্যবিত্তদের বিরাট একটি সম্প্রদায়
তৈরি হয়েছে। এদের সংখ্যাটা নগণ্য হলেও তাঁরা বড় পরিবর্তনের নিয়ামক হতে
পারেন। সামাজিক যোগাযোগকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের আরেকটি পথ হচ্ছে, এ
প্লাটফর্মে তথ্য শেয়ার করা, রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সুবিধা হচ্ছে,
এতে সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। তবে, এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে,
ভুল বার্তা দেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করা।
দেশে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে দেশে ১০ কোটি মানুষের কাছে মোবাইল ফোনের সংযোগ রয়েছে। সামাজিক
যোগাযোগের ওয়েবসাইট সমর্থন করে এমন স্মার্টফোনের দামও সাধ্যের মধ্যে। তাই
সামাজিক যোগাযোগের শক্তি অবহেলা করার মতো নয়। তবে, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
বা সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও সাধারণ মানুষ
বিষয়টিকে সহজভাবে নেবে না।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
BOUNDOLA.COM ( 2010-2013). Powered by Blogger.
0 comments:
Post a Comment